Bangla
5 days ago

মানুষ কেন ঘুষ নেয়?

ঘুষ দেওয়া-নেওয়া উভয়ই দণ্ডনীয় অপরাধ। ছবি হিমটাইমস
ঘুষ দেওয়া-নেওয়া উভয়ই দণ্ডনীয় অপরাধ। ছবি হিমটাইমস

Published :

Updated :

ঘুষ গ্রহণের সাথে একটি প্রচলিত ধারণা ভেসে বেড়ায়; যে বা যারা আর্থিকভাবে বঞ্চিত, কম সুযোগ পায়, কম আয় করে - তাদের মাঝে ঘুষ গ্রহণের প্রবণতা বেশি। আসলেও কি তাই? তাহলে নিচের সত্য ঘটনাটি একটু পড়ে দেখা যাক।

একটি কফিশপে বসে আছেন তিনজন, দেখতে ভদ্রলোক। অন্য দশজনের মতোই কথা বলছেন, খাবার, পরিবেশ এটা-সেটা নিয়ে। কিন্তু এই সবকিছুই মূলত প্রতীকী। তাদের কথা, শব্দ আর নাম সবই গুপ্তচরবৃত্তির একেকটি কোড।

কফিশপের তিন জনের একজন বাঙালি, বাকি দুইজন আমেরিকান যার মধ্যে একজন এফবিআই (ফেডেরাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের) কর্মকর্তা। তারা তিনজনই বাঙালি লোকটার সঙ্গে একটি গোপন চুক্তি সম্পাদন করতে একত্রিত হয়েছেন। কাজটি হলো এফবিআইয়ের কর্মকর্তা বাংলাদেশে ত্রিশ হাজার ডলার। এ নিয়ে তিনজনের মধ্যকার অনেক ই-মেইলও চালাচালি হয়। বাঙালি লোকটি চুক্তি অনুসারে টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় এক পর্যায়ে তাদের সবকিছু ফাঁস হয়ে যায়।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে তিনজনই অভিযুক্ত হয়। আর  এফবিআইয়ের সাবেক গোয়েন্দা ‘ঘুষ’ গ্রহণের দায়ে সাজা পায়।

এই ঘটনার তিনজনই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। একজন এফবিআই অর্থাৎ বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট, বাকি দুইজন ব্যবসায়ী। এর মাঝে বাঙালি লোক রাজনৈতিক দিক থেকেও ক্ষমতাবান। তাহলে ঐ যে মতবাদ ‘সুবিধাবঞ্চিতরা ঘুষ নিবে’ এটি ভুল হয়ে গেল না? যদি ভুল হয় তাহলে কেন ঘুষ খায় মানুষ? লোকে কেন ঘুষ দেয়? এই প্রশ্নটি রয়ে যায়।

গবেষণা  বলে 'সংবদ্ধ থাকা

ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর মনোবিদ্যা বিভাগের গবেষকরা অনেক দিক ধরেই ঘুষ দেয়া-নেয়ার ব্যাপারে কেমন মনস্তাত্ত্বিক তাড়না কাজ করতে পারে এর ওপর পড়াশোনা করছিলেন। দীর্ঘঞসময়ের গবেষণা থেকে তারা যেটা বের করলেন  তা হলো মানুষ সংবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে। সেই সংবদ্ধ থাকাটা অর্থ, ক্ষমতা বা শুধু কাজের স্বার্থে নয় বরং মনস্তাত্ত্বিক নৈকট্যের জন্যও।

কোনো প্রতিষ্ঠানে ১০/১২ জন, কম বা বেশি একটি গ্রুপ আছে। তারা সবাই নিজেদের মাঝে একটি সংস্কৃতি তৈরি করে যেখানে কাজ আদায় করতে মোটিভেশন স্বরূপ টাকা নিয়ে থাকে। এটা ঘুষের অন্যতম কারন। খেয়াল করলে দেখা যাবে- কোনো প্রতিষ্ঠানে ঘুষ কেউ একা নেয় না, সংবদ্ধভাবেই নেয়।

অনেকের কাছেই এটি জানা হলেও এর পেছনে ব্যাখ্যা দেন দুইজন জার্মান মনস্তাত্ত্বিক জিমি ক্যাম্বেল ও আঞ্জা এস. গরিৎজ। জার্নাল অব বিজনেস এথিকসে প্রকাশিত ‘কালচার করাপ্টস: আ কোয়ালিটেটিভ স্টাডি অব অর্গেনাইজেশনাল কালচার ইন করাপ্ট অর্গেনাইজেশন’ গবেষণায় প্রাপ্ত তাদের ফলাফল বলে, "ঘুষ গ্রহীতারা নিজেদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন বলে মনে করেন এবং ‘কোনো কিছুর শেষই প্রমাণ করে যে আপনি কতটা ঠিক' এই নীতিতে বিশ্বাসী। যুদ্ধক্ষেত্রে আছে বলে মনে করায় ঘুষ নেয়াকে তারা বৈধ ও খুন স্বাভাবিক একটা ব্যাপার বলে মনে করে। যুদ্ধের সময় যেরকম সবকিছুই বৈধ ভাবা হয় ঠিক সেরকম।"

'নিরাপত্তা বোধ'

এটি আরেকটি  সম্ভাব্য কারণ যা এই গবেষণায় ওঠে আসে। অর্থাৎ ঘুষ-সংস্কৃতিতে ব্যক্তি ঘুষ নিয়েই বরং নিজেকে নিরাপদ বোধ করেন। সংবদ্ধভাবে ঘুষ নেয়া স্বাভাবিক হওয়ায় না নিলে ব্যক্তি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে। এছাড়া যে ঘুষ নেয় না তাকে সাজাও পেতে দেখা যায়।  এতে করেও নিজে থেকে মানুষ ঘুষ নেয়া শুরু করে।

কয়েকটি স্তর

১. প্রথমে সবাইকে দেখে ঘুষ নিতে কিন্তু ব্যক্তি নেয় না কারণ সদ্য অফিসে এসে তিনি নৈতিক বাধার সম্মুখীন হন।

২. অফিসের সিনিয়র বা আগের কর্মীরা, এতোদিন ঘুষ গ্রহণ করে ঘুষ নেয়ার যে বৈধতা অর্জন করেছেন তা নতুন সহকর্মীকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তারা ঘুষকে আসলে ঘুষ মনে করেন না পারিশ্রমিকই ও ন্যায্য দাবিই মনে করেন। অনেকটা যৌতুককে উপহার হিসেবে দেখার মতন।

৩. উদাহরণ উপস্থাপন করা যে যারা ঘুষ নেয়নি তাদের কী অবস্থা হয়েছে বা হতে পারে।

এভাবেই সদ্য যুক্ত হওয়া একজন কর্মীও ঘুষ নেয়া শুরু করে। যদিও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি হবার আগেই ঘুষ নেয়ার বিষয়টি নির্ধারিত থাকে। হয়তো পারিবারিক আলোচনায় অনেকেই বলতে শুনেছেন, "ছেলে এই... চাকরি করে। মাসিক বেতন এতো টাকা সাথে উপরি তো আছে।"

চাহিদা স্তরের মাধ্যমে ঘুষ নেয়ার প্রবণতা অনুসন্ধান

লাতভিয়ার ডাউগাপিলস ইউনিভার্সিটির  আধ্যাপক এ. ক্রিভেন্স তার ‘মোটিভেশনাল পিকিউলারিটিস অব ব্রাইব-টেইকিং’ গবেষণায় ঘুষ নেয়ার পেছনে কী প্রেরণা কাজ করে সেটি বুঝতে আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম ম্যাসলোর মানুষের ৫টি চাহিদার স্তরের সাহায্য নিয়েছেন।

ম্যাসলোর চাহিদা স্তর ৫টি, শারীরিক চাহিদা, নিরাপত্তা, অধিগ্রহন, আত্মসম্মান ও আত্মজ্ঞান।

খাবারের অভাব, নিরাপত্তার অভাবের জন্যও ঘুষ নেয়া প্রেরণা জোগায়। বিশ শতকের শুরুতে রাশান রাজ্যে এমনটা ঘটতে দেখা যায়। তখন সরকারী কর্মচারীরা বেতন কম পাওয়ায় নিজেদের বেচে থাকার চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে ঘুষ নেয়। সেখান থেকেই ‘গরীব মানুষ ঘুষ নেবে’’ ধারণাটি আরো পাকাপোক্ত হয় তবে এই যুগে এসে এটি খাটে না।

'অধিগ্রহণ' করা অর্থ বোঝায় সমাজ বা গোষ্ঠীর মাঝে আপনার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হওয়া। আগের গবেষণায় 'সংবদ্ধতা'র জন্য ঘুষ গ্রহণের প্রবণতাকেই এখানে অধিগ্রহণ বলা হয়েছে।

'আত্মসম্মানের' জন্যেও ব্যক্তি ঘুষ গ্রনণ করতে পারে। ব্যক্তি যখন নিজেকে ছোট, দুর্বল ও হীনমন্যতায় ভোগে তখন ক্ষমতাবান, শক্তিশালী ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে আগায়। এখান থেকে ঘুষ নেয়ারও প্রবণতা তৈরি হতে পারে।

'আত্মজ্ঞান' বলতেই সবার মাঝে একটি ইতিবাচক নকশা তৈরি হয় কেননা ম্যাসলোর আত্মজ্ঞানীরা এক ধরনের নিজ ও জীবনের দর্শন সম্পর্কে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধারণা হতে পারে যে একজন আত্মজ্ঞানসম্পন্ন লোক কখনো ঘুষ নেবেন না। কিন্তু কোনো ব্যক্তি এই মর্মেই আত্মজ্ঞানী হতে পারেন যে তিনি ঘুষ গ্রহন করবেন।

পার্সনাল ওরিয়েন্টেশন ইনভেন্টরি (পিওআই) বা ব্যক্তি অভিযোজন প্রক্রিয়ায় গবেষক এভারেট ও শোস্ত্রম বলেনে অপরাধীরা সাধানের থেকে বেশি সৃজনশীল এবং তারা নিজের ভালো-মন্দ সম্পর্কে জানাশোনা রাখে। অপরাধ তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তি আগের নিয়মকে ভেঙ্গে নতুন ভাবে নতুন কিছু করবে অথবা কোনো সিস্টেমকে ব্যবহার করতে জানবে। সৃজনশীলতার অনেকগুলো অর্থের মাঝে এটিও অন্যতম। অর্থাৎ যারা ঘুষ নেয় তারা জেনে শুনেই, নিজের সচেতনতা থেকেই ঘুষ নেয় এবং এর জন্যে অপর ব্যক্তিকে ভুল বুঝ দেয়া থেকে শুরু করে নিজের কর্মস্থলে যে ত্রুটিপূর্ণ কাঠামো বিদ্যমান তার যথাযথ প্রয়োগ করতে জানে।

আদিকাল থেকে চলে আসা অপরাধ ঘুষ দেওয়া নেওয়া

ছবি: জিউসের মূর্তির কাঠামো যেখানে ঘুষ দেয়ায় অভিযুক্ত খেলোয়াড়দের নাম লেখা, সূত্র: স্মিথসআনিয়ান ম্যাগাজিন

মানব ইতিহাসের ঘুষের কাহিনী এখনকার নয়। মিশরে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে প্রথম ঘুষ নেয়ার ঘটনা ওঠে আসে। ফারাও রাজার দরবারে বিচার কাজ প্রভাবিত করতে বিচারকদের ঘুষ দেয়ার কথা শোনা যায়। প্রাচীন রোমে  ঘুষের জন্য অলিম্পি গেইমসের নিরপেক্ষতার ওপর প্রশ্ন ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৮ সালে ইউপোলোস নামে একজন অলিম্পিক মুষ্টিযোদ্ধা তার তিনজন  প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারার জন্য ঘুষ দেন।

লেখার শুরু ফিরে গেলে বলাই যায় আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল বা কম বেতন পেলেই ঘুষ নেবে এমনটা না আবার কেউ নিজের আত্মজ্ঞান লাভের পরেও ঘুষ নেবে না এটিও সত্যি নয়। আদতে ক্ষমতা, হীনমন্যতা, সংবদ্ধতা, জ্ঞান যেকোনো কিছুর জন্য ব্যক্তি ঘুষ দেয়া-নেয়াকে বৈধ মনে করতে পারে। বৈধ মনে করলে ব্যক্তির কাছে ঘুষ নেয়াটা অধিকার মনে হবে৷ ফলে সে ঘুষ নিতে বা দিতে পিছপা হয় না।

 

মো. ইমরান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।

[email protected]

Share this news